গ্যাস্ট্রিকের সহজ ঘরোয়া চিকিৎসা 

যখন পাকস্থলীর আস্তরণ কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তাতে প্রদাহের inflammation সৃষ্টি হয়, সেই রোগকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় গ্যাস্ট্রাইটিস gastritis। আমরা অনেকেই এই রোগকে গ্যাস্ট্রিক বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বলে থাকি। এই রোগটি অনেকগুলো কারণেই হতে পারে।

বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এই সমস্যা মারাত্মক হয় না। চিকিৎসা নিলে দ্রুত সেরে ওঠে। কিন্তু চিকিৎসা না করালে এটি বছরের পর বছর ভোগাতে পারে।

এই রোগের লক্ষণগুলো কী?

ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে এই রোগ হলে অনেকেরই কোন লক্ষণ দেখা যায় না। আবার কারো কারো নিচের লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে, 

বদহজম

পেট কামড়ানো বা পেটে জ্বালাপোড়া করা

বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া

খাওয়ার পর পেট ভরা ভরা মনে হওয়া

পাকস্থলীর আস্তরণ ক্ষয় হয়ে erosive gastritis যদি তা পাকস্থলীতে থাকা অ্যাসিডের সংস্পর্শে চলে আসে,  তখন উপরের লক্ষণগুলোর সাথে ব্যথা, রক্তপাত, বা পাকস্থলীর আলসারের মত লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

এই লক্ষণগুলো হঠাৎ করেই তীব্রভাবে শুরু হতে পারে

acute gastritis বা অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে হতে পারে chronic gastritis।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

আপনার যদি বদহজম থাকে, তাহলে আপনি নিজে নিজেই খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে অথবা অ্যান্টাসিড antacid এর মত ওষুধ সেবন করে এর সমাধানের করার চেষ্টা করতে পারেন। তবে নিজে নিজে অ্যান্টাসিড খাওয়ার আগে এই ওষুধ আপনার জন্য নিরাপদ কি না, কিভাবে সেবন করবেন আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো অবশ্যই জেনে নিবেন।

বদহজমের কারণ ও ঘরোয়া সামাধান

একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন যদি

আপনার বদহজমের লক্ষণগুলো এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে থাকে, অথবা বহজমের কারণে পেটে তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি বোধ হয়

কোন ওষুধের কারণে সমস্যাগুলো হচ্ছে বলে মনে হয়

বমি বা পায়খানার সাথে রক্ত যায়, পায়খানা কালচে হয় বা বমির সাথে কফি দানার মত কিছু আসে

পেটে ব্যথা হওয়া মানেই যে সেটা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার লক্ষণ, তা নয়।  অনেক কারণেই পেট ব্যথা হতে পারে, যেমন আটকে থাকা বায়ু, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম Irritable Bowel Syndrome ইত্যাদি।

কী কী পরীক্ষা করা হয়?

ডাক্তার আপনাকে নিচের পরীক্ষাগুলো থেকে এক বা একাধিক পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।

পায়খানা পরীক্ষা stool test  এই পরীক্ষার মাধ্যমে পাকস্থলীতে কোন জীবাণুর সংক্রমণ infection আছে কি না বা পাকস্থলী থেকে রক্ত যাচ্ছে কি না, তা দেখা হয়।

নিঃশ্বাস পরীক্ষা  breath test Helicobacter pylori নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ আছে কি না দেখার জন্য এই পরীক্ষাটি করা হয়। স্বচ্ছ, স্বাদহীন, তেজস্ক্রিয় কার্বনযুক্ত এক গ্লাস তরল পদার্থ পান করে একটি ব্যাগে ফুঁ দিতে বলা হয়।

এন্ডোস্কোপি  endoscopy একটি নমনীয় নল গলার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করিয়ে খাদ্যনালীর মধ্য দিয়ে পাকস্থলীতে নিয়ে গিয়ে প্রদাহের কোন চিহ্ন আছে কি না, তা দেখা হয়।

বেরিয়াম সোয়ালো  Barium swallow বেরিয়াম নামক একটা রাসায়নিক পদার্থের দ্রবণ খেতে দেওয়া হবে। সেই দ্রবণ পরিপাকতন্ত্রের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় এক্স-রে তে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় এবং তা রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে।

এই রোগের কারণগুলো কী?

সাধারণত যেসব কারণে এই রোগ দেখা দেয়, সেগুলো হল, 

Helicobacter pylori নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ

ধূমপান

নিয়মিত অ্যাসপিরিন aspirin আইবুপ্রোফেন ibuprofen বা নন–স্টেরয়েডাল অ্যান্টি–ইনফ্লামেটরি non-steroidal anti-inflammatory জাতীয় কোন ব্যথার ওষুধ সেবন

শরীরের ওপর চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা, যেমন বড় অপারেশন, গুরুতর আঘাত বা কোন জটিল রোগ

অতিরিক্ত কোকেইন বা অ্যালকোহল সেবন

কিছু ক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত নিজের শরীরকেই আক্রমণ করে। পাকস্থলীর আস্তরণকে আক্রমণ করলে এই রোগ দেখা দেয়।

এই রোগের চিকিৎসা কী?

চিকিৎসার মূল ৩টি লক্ষ্য হল, 

পাকস্থলীতে থাকা এসিডের পরিমাণ কমিয়ে লক্ষণগুলো নিরসন করা

পাকস্থলীর আস্তরণ সেরে তোলা

রোগের অন্তর্নিহিত কারণ আছে কি না তা খুঁজে বের করে চিকিৎসা করা

যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়:

অ্যান্টাসিড  antacids  এই সহজলভ্য ওষুধ পাকস্থলীর এসিড প্রশমিত করে দ্রুত ব্যথা কমায়।

হিস্টামিন ২ ব্লকার  Histamine 2 blockers এই ওষুধগুলো পাকস্থলীতে অ্যাসিড তৈরির পরিমাণ কমায়।

প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর  proton pump inhibitors  এই ওষুধগুলিও পাকস্থলীর অ্যাসিড তৈরি কমায়। তবে এরা হিস্টামিন ২ ব্লকারদের থেকেও বেশি কার্যকর। উদাহরণ: ওমেপ্রাজল।

Helicobacter pylori নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হওয়া গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা  H. pylori gastritis

অনেকেই এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সংক্রমিত হলেও বুঝতে পারেন না। বহু মানুষের পাকস্থলীতে এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থাকে, কিন্তু সাধারণত কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে পাকস্থলীর আবরণীতে প্রদাহ হয়ে বারবার বদহজম সৃষ্টি করতে পারে।

এই সমস্যা বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং সাধারণত পাকস্থলীর আবরণী ক্ষয় করে না এমন দীর্ঘমেয়াদী রোগের chronic  persistent non-erosive casesপেছনে দায়ী। ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করার চিকিৎসা না পেলে এই সংক্রমণ সাধারণত সারাজীবন থেকে যায়।

ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করতে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর এর সাথে কিছু এন্টিবায়োটিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেবন করতে হবে।

লক্ষণ উপশমের জন্য আপনি কী করতে পারেন?

আপনার যদি মনে হয় বারবার ব্যথার ওষুধ  NSAIDs সেবন করার কারণে আপনার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার হচ্ছে, তাহলে  NSAIDs দলভুক্ত নয়’ এমন কোন ব্যথার ওষুধ সেবন করা যেতে পারে, যেমন প্যারাসিটামল। এ বিষয়ে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলবো। যেটা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে। আপনার যদি ওজন বেশি হয় তাহলে সেটা  কমানোর চেষ্টা করুন।অতিরিক্ত ওজন অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে ,ডায়াবেটিস হার্টের রোগ ইত্যাদি অনেক কিছুই এই অতিরিক্ত ওজনের সাথে সম্পৃক্ত। তাই ওজন কমিয়ে ফেলা এবং কমানোর পর সেটা ধরে রাখা শ্রেয়। আপনার বুক জ্বালাপোড়া সমস্যা সমাধানেও এটা অনেক সাহায্য করবে। 

ধূমপান বন্ধ করতে হবে।গবেষণায় দেখা গেছে  যারা ধূমপান  কমিয়ে ফেলে বা বন্ধ করে দেয় তাদের এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যায়। ধূমপান নানা রোগের কারণ তাই এই অভ্যাসটা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।

এখন  বলে দিচ্ছি কোন কোন লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন ? 

যদি বারবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেয় ,প্রতিদিনের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় অথবা তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে প্রতিদিনই এই সমস্যা দেখা দেয়, বয়স যদি ৫৫ বা তার বেশি হয়ে থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। কিছু লক্ষণের  কথা আপনার মাথায় রাখতে হবে,এগুলো দেখা দিলে আপনাকে অবশ্যই অবশ্যই চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে এগুলোকে বলে এলার্ম সিমটম।অর্থাৎ এগুলো দেখা দিলে অন্য কোন গুরুতর রোগ হচ্ছে কিনা যাচাই করার প্রয়োজন পড়ে চিকিৎসক সেটা যাচাই করবেন ,তবে লক্ষণ গুলো আপনার জানা থাকা লাগবে যাতে আপনি সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।ছয়টা লক্ষণ আছে?এগুলো ,

১, ওজন অনেক কমে যাচ্ছে  ছাড়াই কোন কারণ ছাড়াই। 

 ২, খাবার গিলতে সমস্যা হচ্ছে,গলায় আটকে যাচ্ছে। 

৩, বারবার বমি হচ্ছে।বমির মধ্যে কফির দানার মত রক্ত দেখা যাচ্ছে 

৪, পায়খানার সাথে রক্ত যাচ্ছে। পায়খানা কালো হচ্ছে। 

 ৫, মনে হচ্ছে পেটে চাকার মতো কিছু হয়েছে। 

৬, আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতায় ভুগছেন, এসব লক্ষণ দেখা দেয়া মানেই গুরুতর হয়েছে এমন না। কিন্তু গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই চিকিৎসকের  সহায়তা নিবেন। আর যদি পেটে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা শুরু হয় তাহলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। 

নিরাপদে থাকবেন।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Call Now Button