ধূমপান ছাড়তে চান কিন্তু পারছেন না। তাহলে এই আলোচনাটি আপনার জন্য।
ধূমপান ছাড়তে গিয়ে অনেকে মাঝপথে মনোবল হারিয়ে ফেলেন। তাই প্রথমে বুঝিয়ে বলছি ধূমপান করলে আপনার শরীরে কি কি ঘটে। আপনারা জানেন অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিজেন প্রথমে ফুসফুসে যায়, সেখান থেকে ঢুকে যায় রক্তে।ফুসফুসে আছে কোটি কোটি বায়ু ধূলি, এ বায়ু ধুলি দিয়ে ফুসফুস থেকে অক্সিজেন রক্তে প্রবেশ করে।
ধুমপান আপনার ফুসফুসের বায়ু ধুলিগুলোকে ধ্বংস করতে থাকে। একবার ধ্বংস হলে বায়ু ধুলি আবার নতুন করে তৈরি হয় না। কোটি কোটি বায়ু ধুলি থাকার কারণে কিছু নষ্ট হলে আমরা বুঝতে পারিনা, তবে নিরবে ফুসফুসের ক্ষতি হতে থাকে।
দিনে দিনে অনেক পরিমাণ বায়ু ধুলি ধ্বংস হলে শুরু হয় শ্বাসকষ্টের রোগ। এই শ্বাসকষ্টের রোগ শুরু হলে তা থেকে আর পুরোপুরি সেরে ওঠার উপায় নেই।
শ্বাস কষ্টের পাশাপাশি ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় অন্তত ২৫ গুণ। শুধু ফুসফুস নয় শরীরে সবখানেই ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে ধূমপান।
মুখ, গলা, পাকস্থলী,লিভার, কিডনি,মুত্রথলী, জরায়ু,এমন লম্বা একটা লিস্ট।কিছু ধুমপানকারি কে বলতে শুনেছি ,ধূমপান তো মাত্র ঝুঁকি বাড়ায়, তার মানে হতেও পারে নাও হতে পারে। আমার হয়তো হবে না। এই চিন্তা যারা করেন তাদের জন্য দুইটা সংখ্যা তুলে ধরছি,
এক, যারা ধূমপান করে, তাদের প্রতি দুইজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটায় ধূমপান।অর্থাৎ জগতের যত মৃত্যুর কারণ আছে সে সবগুলো কারণ মিলে ৫০ জন ধুমপাই মৃত্যু ঘটালে বাকি ৫০ জনের মৃত্যু ধূমপান একাই ঘটায়।
দুই, ধূমপান কারীরা গড় এ ৮ থেকে ১০ বছর কম বাঁচে। অর্থাৎ আপনার অধুমপাই বন্ধু ৭০ বছর বাঁচলে ,আপনার বাঁচার সম্ভাবনা ৬০ থেকে ৬২ বছর। আবার কিছু ধূমপানকারী আছেন তারা বলেন, মৃত্যু যখন আসবে আসবেই। ক্যান্সারের ভয় করিনা। যতদিন বেঁচে আছি আনন্দে বাঁচতে চাই। এখানে সমস্যা হল ধূমপান মৃত্যুর আগেও আপনার আনন্দ সহ্য করতে পারে না।
ধূমপান দীর্ঘদিন করলে প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়া অর্থাৎ বাচ্চা হতে সমস্যা হওয়া। বাচ্চা হলে বাচ্চার শরীরে জন্মগত ত্রুটি থাকা। অল্প বয়সে চামড়া ভাজপরা হার নরম হয়ে যাওয়া যে কারণে হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে। দাঁত মাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়া ,দাঁত পড়ে যাওয়া, চোখে ছানি পড়া ,শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, কারণে করোনা হলে ঝুঁকি বেশি।
ধূমপান হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এটা শুনলে অনেকেই বলেন,যারা ধূমপান করে না তাদেরও তো হার্ট অ্যাটাক স্ট্রোক, হয়।কথা ঠিক কিন্তু যুক্তি ভুল। এ কথাগুলা শোনার পর কেউ কেউ বলেন,ধূমপান করে শরীরে যা ক্ষতি হওয়ার সেগুলো তো হয়ে গেছে,এখন আর ধূমপান ছেড়ে কোন লাভ হবে না। এটা সম্পূর্ণ একটা ভুল কথা। আপনি যতদিন ধরে ধূমপান করেন না কেন, যে মুহূর্ত থেকে আপনি ধূমপান ছাড়বেন তখন থেকেই আপনার শরীর নিজেকে মেরামতের কাজ শুরু করে দিবে।
কি মেরামত করে?
শেষ সিগারেট খাওয়ার
- ২০ মিনিটের মধ্যেই হার্ট বিট ও ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
- ৮ ঘণ্টার মধ্যে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শরীর থেকে সব ক্ষতিকর কার্বন মনোক্সাইড দূর হয়ে যায়, নাকের ঘ্রাণ ও মুখের স্বাদ ফিরে আসে,
- ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসতন্ত্র প্রসারিত হওয়া শুরু করে ফলে শ্বাস নেয়া সহজতর হয়।
- তিন থেকে নয় মাসের মধ্যে ফুসফুসের ক্ষমতার ১০% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
- এক বছর এর মধ্যে আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে।
- পাঁচ বছরের মধ্যে, মুখ ,গলা খাদ্যনালী, আর মূত্রথলির ক্যান্সার এর ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে। জরায়ু ক্যান্সার আর স্টকের ঝুঁকি একজন অধুমপায়ীর সমান হয়ে যায়।
- দশ বছর পর ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যু হওয়ার ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে।
- পনেরো বছর পর আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি আর যে কখনো ধূমপান করেনি তার হার্ট এটাকের ঝুঁকি সমান হয়ে যায়।
আশা করি আপনার ধূমপান ছাড়ার মনোবল শক্ত হয়েছে।
এখন বলে দিচ্ছি ধূমপান ছাড়ার সাতটি পরামর্শ।
এক ,সিগারেট এ আর একটাও টান দেয়া যাবে না। যখন আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন ধূমপান ছাড়বেন তারপর থেকে আর একটাও সিগারেট ব্যবহার করবেন না। গবেষণায় দেখা গেছে জাস্ট একটা সিগারেট বা শুধু একটা টান দেবে এমন চিন্তা থাকলে একটা ধূমপানকারী আবার আগের মতো নেশায় জড়িয়ে যায়। তাই চিন্তা শক্ত থাকতে হবে। যাতে একটা সিগারেটও ব্যবহার করা যাবে না।
যেসব জায়গায় আপনি ধূমপান করতেন পারলে সে সব জায়গায় ত্যাগ করুন।
দুই ,ধূমপান বন্ধ করলে প্রথম কিছুদিন আপনার খারাপ লাগবে। এই খারাপ লাগার কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা আগে থেকে করে নিতে হবে।শরীরে যেসব প্রতিক্রিয়া, দেখা দিতে পারে অস্থিরতা,মেজাজ খিটখিটে হওয়া,ক্লান্ত লাগা ঘুমের সমস্যা,কোষ্ঠকাঠিন্য ,কোন কাজে মনোযোগ না আসা এগুলো দেখা দিলে ঘাবড়ে যাবেন না। জানবেন এগুলা স্বাভাবিক এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেরে যাবে।
তিন ,ধূমপানের ইচ্ছা দমন করার উপায় বের করে রাখতে হবে। যখন সিগারেট টান দিতে খুব ইচ্ছা করবে তখন ঠেকানোর চেষ্টা করবেন। নিজের মনকে অন্যদিকে নিতে হবে। বিভিন্ন ধরনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। একজন বন্ধু নির্ধারণ করে রাখবেন আপনার প্রিয় কোন বিষয় গল্প শুরু করবেন। যে কারণে আপনি ধূমপান ছাড়তে চান সেটা চিন্তা করেন। বাইরে থেকে একটু হেটে আসতে পারেন শারীরিক ব্যায়াম করতে পারেন। ধুমপান করেনা এমন বন্ধুর সাথে বেশি সময় কাটান। কেউ আপনাকে ধুমপান করতে বললে সেটা কিভাবে না বলবেন সেটা চিন্তা করবেন। প্রতিদিন ৫ মিনিট করে ব্যায়াম করলেও তা ধূমপানের ইচ্ছা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
ছয় ,কিছু ওষুধ ,নিকোটিন প্যাচ,ইনহেলারস,স্প্রে আপনাকে এগুলা ব্যবহার করতে পারেন এগুলা ধূমপানের তাড়না কমাবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে যেটা আপনার জন্য ভালো হয় সেটা শুরু করতে পারেন।
সাত ,ছেড়ে দেওয়ার পরে আবার ধূমপান করলে নিরাশ হবেন না। সিংহভাগ ধূমপাই প্রথম অবস্থায় ধূমপান ছাড়তে ব্যর্থ হয়। তাই বলে নিরাশ হবেন না।যারা ধূমপান সেরেছেন তাদের মধ্যে বেশিভাগ সফল হয়েছে কয়েকবার চেষ্টা করার পরে। তাই আপনি ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু করার পরে কোন কারণে যদি একবার ধূমপান করে ফেলেন নিরাশ হবেন না। কোন পরিস্থিতিতে আপনি নিজেকে আটকাতে পারেননি সেটা যাচাই করবেন, যাতে একই ভুল আর না করেন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন তবে ধূমপান বন্ধ না করে হাল ছাড়বেন না।
নিরাপদে থাকবেন।
Leave a Reply