সাদা চাল আর লাল চালের মধ্যে পার্থক্য অনেক। কোনটা আমাদের স্বাস্থ্যের কি উপকার ও অপকার করে তা আজকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলব।
প্রথমে বলি সাদা চাল আর সাদা আটা কিভাবে তৈরি হয়?
ধান ,গম, বা যে কোন শস্য দানার তিনটি অংশ থাকে। শস্যদানার বাইরের আস্তরণ কে বলা হয় ব্রান। বাংলায় আমরা এ অংশকে সাধারণত কুড়া বলেছি। এই ব্রান বা কুড়াতে অনেক পুষ্টি উপাদান আছে। আইরন ,কপার জিরিং,ম্যাগনেসিয়াম ,ভিটামিন বি আর থাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। এগুলোর একেকটা একেক রকম কাজ করে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে। শস্যদানা থেকে যখন মেশিনে সাদা চাল বানানো হয়, তখন পুষ্টিকর এই বাইরের আস্তরণ অর্থাৎ ব্রান বা কুড়া ফেলে দেয়া হয়। তার মানে চাল থেকে ফাইবার চলে যায়। তখন চালের পুষ্টিগুণ অনেক কমে যায়।
শস্যদানার ভেতরের অংশকে বলে জার্ম। এখান থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্মাবে। জার্ম এর ভিতরে একদম পুষ্টি ভরপুর। ভিটামিন বি, ভিটামিন ই, স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফ্যাট, ফাইটোকেমিক্যালস, এন্টিঅক্সিডেন্টস থাকে এরমধ্যে। চালের মধ্যে এই অংশটা থাকলে চাল অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায় না।এটা ফেলে দিলে অনেক দিন গোদামে বা দোকানে চাল রেখে দেয়া যায়। তাই সাদা চাল বানানোর সময় এই পুষ্টিকর অংশটুকুও ফেলে দেয়া হয়। সাদা চালে থাকে শুধু ইন্ডোস্পার্ম ।এখানে মূলত কার্বোহাইড্রেট থাকে, আর খুব অল্প পুষ্টি থাকে। সামান্য পরিমানে ভিটামিন বি, প্রোটিন,মিনারেল থাকে। অর্থাৎ পুষ্টিগুণ একেবারেই কম যেখানে সেটাই থাকে সাদা চালে।সাদা আটাতেও তাই। গন থেকে মেশিনে যখন সাদা আটা বানানো হয়,৯০ শতাংশ ভিটামিন ই,৫০ শতাংশ ভিটামিন বি এবং ১০০ শতাংশ ফাইবার উধাও হয়ে যায়। লাভ যেটা হয় সেটা হল এই আটা দিয়ে সুন্দর পাউরুটি ,পরোটা , বানানো যায়,এবং এগুলো অনেকদিন দোকানে সংরক্ষণ করা যায়। যখন শস্যদানা তিনটা অংশই অটুট থাকে এটাকে বলে লাল চাল।আমরা লালচাল বলতে এই পুরো শস্যদানা কে বুঝায়।চালের রং লাল হতে হবে সেটা বাধ্যতামূলক নয়। তিনটাই অংশ থাকলে এই চাল রান্না করতে সময় বেশি লাগবে। খেতে একটু শক্ত লাগে কিন্তু এতে অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে। আবার শস্যদানা তিনটে অংশের মেশিনে ঢুকিয়ে আটা বানানো হয়,সেটা হচ্ছে লাল আটা।
তবে এই দুই প্রকারের চালের পার্থক্য পুষ্টিতেই শেষ নয়। এই দুই প্রকারের চাল খেলে শরীরে কি ঘটে, সেটা বুঝিয়ে বলব?
কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার পরে সেটা ভেঙ্গে আমাদের শরীরে চিনি তৈরি করে। সেখান থেকে চিনি রক্তে প্রবেশ করে। রক্ত যখন চিনে পরিমাণ বাড়তে থাকে তখন আমাদের শরীর একটা হরমোন বানানো শুরু করে। এই হরমোনের নাম হল ইনসুলিন। ইনসুলিন দিয়ে রক্তে চিনির পরিমাণ কমায়। চিনি গুলোকে রক্ত থেকে সরিয়ে আমাদের কোষের ভিতর ঢুকায়,সেখান থেকে আমরা শক্তি পাই। কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার পরে কত দ্রুত আমাদের রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়।সেটার পরিমাপ হচ্ছে গ্লাইসেমিক ইনটেক্স।
সাধারণ নিয়ম হল কম গ্লাইসেমিক ইনটেক্স এর খাবার গুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো অর্থাৎ যে খাবারগুলো খেলে রক্তে আস্তে আস্তে চিনির পরিমাণ বারে হুট করে অনেক পরিমাণে বেড়ে যায় না সে খাবার গুলো ভালো। যেসব খাবারে গ্লাইসেমিক ইনটেক্স বেশি সেগুলো রক্তে চিনির পরিমাণ খুব দ্রুত বাড়ায়। এমন একটা খাবার হল সাদা চালের ভাত। খুব তাড়াতাড়ি শরীরে এই খাবার ভেঙ্গে চিনি তৈরি করতে পারে। এবং অল্প সময় রক্তে অনেক পরিমাণ চিনি চলে আসে। রক্তে এত বেশি চিনি কমানোর জন্য অনেক পরিমান ইনসুলিন প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে লাল চালের ভাতে গ্লাইসেমিক ইনটেক্স অনেক কম।এটা ভাঙতে শরীরে বেশ সময় লাগে রক্ত চিনির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ে,ফলে ইনসুলিন কম প্রয়োজন হয়।আর অনেকক্ষণ পেট ভরা ভরা লাগে। আপনারা অনেকে হয়তো ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ হিসেবে ইনসুলিন নাম শুনেছেন। যারা ডায়াবেটিসে ভোগে তাদের শরীর হয় ইনসুলিন তৈরি পারেনা অথবা শরীরে ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে থাকে, ওষুধ খেয়ে বা বাইরে থেকে ইনসুলিন নিয়ে রক্তে চিনির পরিমাণ কমাতে হয়। তবে এইখানে আরেকটা কথা ,খাবারের গুনাগুন নির্ধারণ করার জন্য শুধুমাত্র গ্লাইসেমিক ইনটেক্স ব্যবহার করাই যথেষ্ট নয়। এটা একটা উপায় মাত্র। যেমন চকলেট কেক এ গ্লাইসেমেক ইনটেক্স কম,তাই বলে কি এটা স্বাস্থ্যকর নয় এটা মোটামুটি আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারি।
আড়াই লক্ষেরও বেশি মানুষের উপর করা সাতটি গবেষণা একত্রে করে দেখা হয়েছে। যে যারা প্রতিদিন হোল গ্রীন খায় আর যারা খায় না তাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ,স্ট্রোকের ঝুঁকির মতো কোনো পার্থক্য আছে কিনা। ফলাফল কি পাওয়া গেল?
যারা হোল গ্রীন বা গোটা শস্য দানা খেয়েছে তাদের হার্ট অ্যাটাক,স্ট্রোক ঝুঁকি ২১ শতাংশ কম ছিল। আর একটা গবেষণায় দেখা গেছে, জাপানিজ ও চাইনিজ মানুষদের মধ্যে যারা সাদা ভাত সবচেয়ে বেশি খায় তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৫৫ শতাংশ বেশি।আবার প্রায় চার লক্ষ মানুষের মধ্যে দশটা করা গবেষণা একত্রে করে দেখা গেছে সারা দিনে দেড় কাপ লাল ভাত খায়,তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমেছে ৩২ শতাংশ। শুধু হার্ট অ্যাটাক স্টক ডায়াবেটিসের মতো প্রাণঘাতী ও অসুখ না, কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাইলসের মতো পীড়াদায়ক অসুখকে দূরে রাখে লাল চাল আটা।অর্থাৎ লাল চাল আর লাল আটায় যে ফাইবার থাকে তা খাবার হজমে সাহায্য করে। মল নরম করে ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না। আর আপনার যদি মনে হয় আপনার খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন আনবেন তবে গোটা শস্য দানা বেশি খাবেন।
তাহলে আপনার জন্য তিনটি পরামর্শ।
এক, আস্তে আস্তে শুরু করবেন। প্রথমে নতুন কিছু খেলে সেটা সব ভালো লাগে না। একবারে পুরোটা না বদলাতে পারলে অল্প অল্প করে খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারেন। সাদা ভাতের সাথে লাল ভাত মিশিয়ে খেলেন। সাদা আটা রুটির সাথে একটা লাল আটা রুটি খেলেন। এভাবে পরিবর্তন করতে পারেন।
দুই,ভাত রুটি ছাড়াও অন্যান্য হোল গ্রীন খেতে পারেন। যেমন নাস্তা খাওয়ার জন্য ওটস খেতে পারেন।
তিন, লাল চাল বা লাল আটা খেলেই যে পরিমাণে বেশি খাওয়া যাবে তা কিন্তু না। সুষম খাবারে অংশ হিসেবে আপনি লাল চাল,আর লাল আটা খাবেন। চেষ্টা করবেন দিনের অর্ধেক বেলা শাকসবজি ফলমূল খাবেন।
লাল আটা আর লাল চালে ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার, আছে যা সাদা চাল আর সাদা আটায় পাওয়া যায় না। এই খাবারগুলো স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেটের উৎস ,এই খাবারগুলো ডাইবেটিস, হার্ট এটাক, স্টোক ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি কমায় এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য ও দূর করে।
নিরাপদে থাকবেন।
Leave a Reply