যারা বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় জানাতে আজকে আলোচনাটি করছি।
কিছু রোগ আছে যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না,কিন্তু বিয়ের পরে খুব সহজে স্বামী থেকে স্ত্রী, স্ত্রী থেকে স্বামী বা তারা যখন সন্তান নেন তাদের মাঝে ছড়াতে পারে।
একটু সচেতন হয়ে আগেই কিছু টেস্ট করালে রোগগুলো ধরা সম্ভব,চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা বা পরিবারের মাঝে বিস্তার রোধ করা সম্ভব। আমি মোট ছয়টা পরীক্ষার কথা বলব। প্রত্যেকটার উদ্দেশ্য সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিব।
এক, থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা।
প্রায় ১০ বছর আগের কথা আমি তখন মেডিকেল কলেজে পড়ি। ফোন পেয়ে একজন রোগীর জন্য রক্ত দান করতে গিয়েছি।গিয়ে দেখি যার রক্ত লাগবে সে একজন শিশু,বয়স হবে মাত্র ১০ কি ১১।প্রতি মাসেই তার রক্ত নেয়া লাগে।সাথে ওর বাবা-মা ছিল। বলছিল প্রতি মাসে রক্ত জোগাড় করতে তাদের অনেক কষ্ট হয় তাও তারা সাধ্যমত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এই শিশুটার যে রোগ হয়েছিল তার নাম থ্যালাসেমিয়া। থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ যোগ্য। সিম্পল একটা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেয়া যায় সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি নেই? যেহেতু শিশুটির বাবা-মা টেস্ট আগে থেকে করিয়ে নেন নাই তাই তাদের জানা ছিল না যে তাদের সন্তানের এমন একটা জটিল রোগ হতে পারে। আমি সেদিন সংকল্প করি যে যত জনকে সম্ভব এই রোগের ব্যাপারে সচেতন করব। আমি সেই শিশুর ঘটনা দিয়ে বিষয়টা সহজ করে বুঝিয়ে বলি। শিশুর এই জটিল রোগটা এসেছিল তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। বাবা-মা দুইজনেরই থ্যালাসেমিয়া মাইনর ছিল।কিন্তু তারা তা জানতেন না। বাবা-মা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন কোন অসুখ ছিল না, কোন লক্ষণ ছিল না, এটা নিয়ে তারা কখনো চিন্তাও করেননি এবং বেশিরভাগ মানুষ যাদের থ্যালাসেমিয়া মাইনর থাকে তাদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়,তারা সম্পূর্ণ সুস্থ থাকেন কখনো কখনো একটু রক্তশূন্যতা দেখা যায়। যখন সন্তান থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায় তখন তারা প্রথম জানতে পারেন যে তাদের নিজেদের থ্যালাসেমিয়া মাইনর ছিল। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের সন্তান একটা গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে,যা শিশুটাকে সারা জীবন ভোগাতে পারে।
তাহলে করণীয় কি?
বিয়ের আগে দুইজনেই একটা রক্ত পরীক্ষা করবেন। তাহলে তখনই ধরা পড়বে আপনাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা।এই রক্ত পরীক্ষার নাম হচ্ছে HB electrophoresis ।একটা পরীক্ষায় দেড় হাজার টাকার মত পড়বে একটু বেশি মনে হতে পারে তবে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে এটা কিন্তু খুব বেশি না।
পরীক্ষা করলে কেমন ফলাফল আসতে পারে?
মোটা দাগে তিন ধরনের ফলাফল আসতে পারে।
এক,
দুজনের একজনের ও রক্তে কোন সমস্যা নাই।এমন ফলাফল আসলে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নাই।
দুই,
দুইজনের মধ্যে একজনের থ্যালাসেমিয়া মাইনর ধরা পড়লে,
এই ক্ষেত্রেও বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নাই। তবে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া মাইনর হওয়া ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ বাচ্চা অসুস্থ হবে না কিন্তু সে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হতে পারে। অর্থাৎ প্রথম দুই ধরনের ফলাফলের দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নাই।
এখন আসি তৃতীয় ধরনের ফলাফলে।
দুইজনেরই থ্যালাসেমিয়া মাইনর ধরা পড়লে ,এই ক্ষেত্রে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা আছে।
কতটুকু?
২৫ শতাংশ।
আর ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা একদম স্বাভাবিক সন্তান হওয়ার।৫০ শতাংশ সম্ভাবনা থ্যালাসেমিয়া মাইনোর নিয়ে জন্মানোর। অর্থাৎ এই ধরনের ফলাফল আসলে ভাবনা-চিন্তার ব্যাপার আছে।প্রত্যেক প্রেগনেন্সিতেই বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ।এই তথ্য বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে এই দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন কিনা। হলেও সন্তান নেবেন কিনা আর সন্তান যদি থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায় ,সে ক্ষেত্রে আগে থেকেই মানসিক আর্থিক প্রস্তুতি নেয়ার একটা ব্যাপার থাকে।
দুই হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা ,
হেপাটাইটিস বি একটা ভাইরাস। যা আমাদের লিভারের গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু যাদের শরীরে এই ভাইরাসটা বসবাস করছে,তারা অনেকেই জানেন না যে তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত। ফলে নিজের অজান্তেই তারা অন্য মানুষের মাঝেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে।
সুরক্ষা ছাড়া সহবাস করলে একজন থেকে আরেকজনের শরীরে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সহজেই এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই বিয়ের আগেই দুইজনেই এটা পরীক্ষা করে নিতে পারেন। একজন আক্রান্ত হলেও আরেকজনে যাতে না ছড়াই,সেই সর্তকতা গুলোও তখন নেয়া যাবে।

কোন পরীক্ষা করাবেন?
দেখিয়ে দিচ্ছি,
(HBsAg এবং Anti-HBc)
দুইজনেরই পরীক্ষা নেগেটিভ আসলে তো কোন দুশ্চিন্তা নাই।তবে ভবিষ্যতেও সুরক্ষিত থাকার জন্য হেপাটাইটিস বি টিকা নিয়ে নিতে পারেন যদি আগে না নেয়া থাকে।
২০০৩ সালে বাংলাদেশের শিশুদের এই টিকা দেয়া শুরু হয়।তাই আপনার জন্ম তার আগে হলে আলাদা করে টিকা প্রয়োজন হতে পারে। যদি একজনের কারো পরীক্ষার পজিটিভ আসে,তখন আপনার চিকিৎসক আরো কিছু পরীক্ষা করতে দিবেন যাতে সঠিক চিকিৎসা দেয়া যায়। যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তার শরীরে যাতে এ ভাইরাস না ছড়ায়। সেজন্য টিকা, সহবাসের সময় কনডম ব্যবহার সহ আরো কি কি সর্তকতা অবলম্বন করা প্রয়োজন সে বিষয়ে আপনার চিকিৎসক আপনাকে পরামর্শ দিবেন। এই সব কিছু বিবেচনায় রেখে আপনারা পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারবেন। এখন অনেকে মনে করতে পারেন যে এটা বুঝি যৌন রোগ। আমি আগে যেহেতু কখনো সহবাস করি নাই ,তাই আমার এটা থাকার কোন সম্ভাবনা নাই।
এটা ভুল ধারণা।
সহবাস ছাড়াও আরো অনেক ভাবে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
কিভাবে একজন থেকে আরেকজনের শরীরের এই ভাইরাস ছড়ায়?
আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে, বীর্যে, সাদাস্রাব ইত্যাদিতে এ ভাইরাস থাকে তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে একই ব্লেড রেজার বা টুথব্রাশ ব্যবহার করলে ,একই স্যুই ব্যবহার করলে যেমন নাক ফুটো বা কান ফুটো করার সময় ,একই ইনজেকশন ব্যবহার করলে এমন হাসপাতালে বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিলে যেখানে যন্ত্রপাতি ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয় না,রক্ত আদান-প্রদানে,সুরক্ষা ছাড়া সহবাসের মাধ্যমে এবং জন্মের সময় মা থেকে শিশুর শরীরে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।অবশ্য এখন রক্ত দেয়ার আগে প্রায় সব জায়গাতেই দেখে নেয়া হয় রক্তে এ ভাইরাস আছে কিনা।অর্থাৎ সহবাস ছাড়াও আরো অনেক ভাবে এটা ছড়াতে পারে। আপনার অজান্তে আপনিও আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। সেটা আগে আগে জেনে নিলে আপনার আর আপনার পার্টনারের সুস্থতার জন্য পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো নিতে সাহায্য করবে।
৩. হেপাটাইটিস সি পরীক্ষা।
হেপাটাইটিস বি এর মত হেপাটাইটিস সি, ও এক ধরনের ভাইরাস যা লিভারের অনেক ক্ষতি করতে পারে। এটা ছড়ায় সাধারণত রক্তের মাধ্যমে।একই সুই বা ইনজেকশন ব্যবহার করলে যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত লেগে থাকতে পারে,চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত না করলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। লিভার অনেকটুকু নষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণত কোন লক্ষণ দেখা যায় না। অর্থাৎ অজান্তে অনেকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে এবং অন্যদের মাঝে ছড়াতে পারে। সুরক্ষা ছাড়া সহবাসের মাধ্যমে এবং মা থেকে সন্তানের শরীরে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে,যদিও এভাবে ছড়ানোর সম্ভাবনা খুব কম। তবে কম হলেও যেহেতু একটা সম্ভাবনা আছে,স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ছড়ানো এবং মা থেকে সন্তানের ছড়ানোর,তাই পরীক্ষা করিয়ে নেয়াই শ্রেয়।এই পরীক্ষাটা করে নিতে পারেন,
( Anti-HCV)
খরচ পড়তে পারে এক থেকে দেড় হাজারের মতো। পজেটিভ আসলে আপনার চিকিৎসক আরো কিছু পরীক্ষা করতে বলবেন কনফার্ম হবার জন্য এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদানের জন্য।
হেপাটাইটিস সি চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়ে যেতে পারে। আর আপনার কাছ থেকে আপনার পার্টনারের শরীরে এই ভাইরাস যাতে না ছড়ায় সেজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
৪. এইচআইভি পরীক্ষা।
এইচআইভি সম্বন্ধে আপনারা অনেকেই জানেন। আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সহবাসের মাধ্যমে সাধারণত এটা ছড়ায়। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে একই বা ইনজেকশন ব্যবহার করলে,জন্মের সময়ে মায়ের কাছ থেকে বা মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে শিশু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে বহুবছর ধরে এই এইচআইভি ভাইরাসের কোন লক্ষণ নাও থাকতে পারে। আর সেই সময়ে আক্রান্ত একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে।তাই পরীক্ষা করে নেয়াই শ্রেয়।
কোন পরীক্ষা তা করবেন?
HIV AG/Ab.
৬০০ থেকে ১০০০ এর মতো খরচ করতে পারে। পজেটিভ আসলে চিকিৎসার জন্য ওষুধ শুরু করতে পারবেন, যা আপনার রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে আনবে। কয়েক মাসের মধ্যে ভাইরাসের পরিমাণ এতটাও কমে যেতে পারে যে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি এটা আর কাউকে ছড়াতে পারবেন না।
৫. যৌনবাহিত রোগ পরীক্ষা।
অনেকেই যৌনবাহিত রোগে বা
sexually transmitted infections এ ভোগেন কিন্তু জানেন না।শুধুমাত্র টেস্ট করার পরে ধরা পড়ে। কিন্তু অনেকেরই যেহেতু কোন লক্ষণ থাকে না,ফলে টেস্ট করা হয় না চিকিৎসাও হয় না। পরে নানান ধরনের শারীরিক সমস্যা এবং সন্তান ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।অথচ সময় মত অল্প কয়েক দিনে অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স নিলেই রোগটা সেরে যেতো।এই চারটা কমন যৌনবাহিত রোগ পরীক্ষা করতে পারেন।
(সিফিলিস)
(গনোরিয়া)
(ক্ল্যামিডিয়া)
(ট্রিকোমনাইসিস)
রোগ ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসা করাতে পারবেন। এবং একজন থেকে আরেকজনের ছড়ানো ঠেকাতে পারবেন।
৬. ব্লাড গ্রুপ।
বিয়ের আগে রক্তের গ্রুপ জানতেই হবে এমন না।অনেকের একটা ধারণা আছে যে স্বামী স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ একই হলে সমস্যা হতে পারে।এই কথার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হলে এবং গর্ভের সন্তানের রক্তের গ্রুপ পজেটিভ হলে প্রেগনেন্সিতে বা বাচ্চা জন্মের পরপর একটা ইনজেকশন দিতে হয়। যেটা আপনার চিকিৎসকই তখন বলে দিবেন। তাও একজন আরেকজনের রক্তের গ্রুপ জানা থাকা ভালো। হঠাৎ কোনো বিপদে পড়লে কাজে লাগতে পারে। তাই রক্তের গ্রুপ জানা না থাকলে বিয়ের আগে এই পরীক্ষাটা করিয়ে নিতে পারেন।
আমি আলোচনায় যেই পরীক্ষাগুলোর কথা বললাম,সবগুলোর কারণ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি কেন বিয়ের আগে এই পরীক্ষাগুলো করা গুরুত্বপূর্ণ।আরো ভালো হয় যদি দুজন মিলে বিয়ের আগে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে পারেন। আপনাদের পরিবারে কি কি রোগ আছে আপনাদের স্বাস্থ্য কেমন,সেগুলো বিবেচনায় রেখে তিনি আরো ভালোভাবে পরামর্শ দিতে পারবেন। আরেকটা বিশেষ কথা আমি যে টেস্ট গুলোর কথা বলেছি,সেগুলোর কোনটাতে রোগ ধরা না পড়লেই যে বিয়ে করা যাবে না, তা না। অনেকগুলো রোগের চিকিৎসা আছে,একজন থেকে আরেকজনের যাতে না ছড়ায় তেমন অনেক ব্যবস্থা আছে।
Leave a Reply