ভুল পজিশনে ঘুম পাড়ানোর জন্য ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সালে হাজার হাজার শিশু ঘুমের মধ্যে মারা যায়।বাবা মা যদি সঠিক তথ্যটা জানতেন তাহলে এই শিশুগুলো হয়তো আজও বেঁচে থাকত।
কিভাবে এমন হলো?
পুরো গল্পটা বলতে বলতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানিয়ে দিব।
ডাক্তার স্পক একজন বিখ্যাত শিশু ডাক্তার ছিলেন তিনি একটা বই লেখেন, baby and child, কেয়ার নামে।
বইটা খুব জনপ্রিয় হয় কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়ে যায়।
সেই বইতে ডক্টর স্পক পরামর্শ দেন শিশুদেরকে বিছানায় চিত করে না শুয়ে উপর করে ঘুম পাড়াতে।তিনি তার কথার পক্ষে কিছু যুক্তি দেন,শিশুকে চিত করে শুইয়ে ঘুমানোর দুইটা অসুবিধার কথা তিনি বলেন।
এক,
ঘুমের মধ্যে শিশু যদি বমি করে।
চিত হয়ে শুয়ে থাকলে সেই বমি তখন শ্বাসনালীতে ঢুকে বাচ্চার শ্বাস আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
দুই ,
চিৎ হয়ে শুলে বাচ্চার সাধারণত একদিকে মাথা কাত করে থাকে।ফলে মাথা সেই দিকে গোল না হয়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতে পারে।
তাই তিনি পরামর্শ দেন যে শুরু থেকেই বাচ্চাকে উপুড় করে শুয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করাতে। কথাগুলো শুনতে যুক্তিপূর্ণ মনে হয়, আবার খুব পরিচিত একজন ডাক্তার বলছেন।
তো যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশে লাখ লাখ বাবা-মা তাদের সন্তানকে উপুড় করে শুয়ে ঘুম পাড়াতে শুরু করেন।হাসপাতাল গুলোতেও এই চর্চা শুরু হয়।
যে শিশুরা সেখানে ভর্তি তাদেরকে উপুড় করে ঘুম পাড়ানো শুরু হয়।তো এটার পাশাপাশি আরেকটা জিনিস হওয়া শুরু করল অনেকগুলো দেশে শিশু মৃত্যুহার বেড়ে চলতে লাগলো।
এই শিশু মৃত্যু কেমন?
একদম সম্পূর্ণ সুস্থ শিশু ঘুমের মধ্যে মারা যাচ্ছে। বেশিরভাগ এর বয়স ৬ মাসের কম। কেন মারা যাচ্ছে তার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।এটা কে sids বলে।অনেকে এটাকে Cot death ও বলে।
ছোট বাচ্চারা যে খাটের সয় সেটা cot।আর সেখানে ঘুমের মধ্যে মারা যায় বলে Cot death।বুঝতেই পারছেন একটা পরিবারের জন্য এটা কতটা বেদনাদায়ক হতে পারে। একদম সুস্থ বাচ্চা ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেছে বাবা-মা আর এসে দেখে বাচ্চা নিথর হয়ে আছে। না, ফেরার দেশে চলে গেছে। গবেষকেরা অনেক খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন যে কি কারণে এই শিশুগুলো মারা যাচ্ছে। শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস হৃদস্পন্দন ইসিজি, অসুস্থতার লক্ষণ,বাইরের আবহাওয়া তাপমাত্রা কোনটা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে তা গবেষণা করে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু কোন কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না তখন কয়েকজন বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে, শিশু উপুড় হয়ে ঘুমানোর সাথে একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এটা প্রথমে কেউ খুব বিশ্বাস করল না।

এমন সাধারন একটা বিষয়,শিশু উপুড় হয়ে ঘুমালো না চিত হয়ে ঘুমালো ,
এটা কি জীবন মরনের কারণ হতে পারে?
কিন্তু পরে দেখা গেল যে বাচ্চাগুলো মারা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই বিছানা উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থায় মারা গেছে।
অন্যদিকে, যারা চিত হয়ে ঘুমায় তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার অনেক কম।
আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকল যে উপুড় হয়ে ঘুমালে বাচ্চার মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
আমরা এখন জানি যে চিৎ হয়ে ঘুমের সাথে তুলনা করলে যে শিশুরা উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে তাদের মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা প্রায় ১৩ গুন পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ ,প্রথমে যে ডাক্তারের কথা বলে শুরু করলাম ডাক্তার স্পক তিনি যে পরামর্শ দিয়েছিলেন শিশুকে উপুড় করে শোয়াতে সেটা একটা মারাত্মক ভুল পরামর্শ ছিল। কিন্তু যতদিনে আমরা জানতে পেরেছি এটা ভুল পরামর্শ, ততদিনে অনেক শিশু মারা গিয়েছে। উনার যে দুটো যুক্তি ছিল ঘুমের মধ্যে বাচ্চা বমি করলে শ্বাস আটকে যেতে পারে আর চিত করে শোয়ালে মাথা চ্যাপ্টা হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে মাথা একটু চ্যাপ্টা হলেও বাচ্চা যখন বসা শুরু করে সেটা এমনি এমনি চলে যায়। আর বাচ্চা বমি করলে বাচ্চা সেটা গিলে ফেলতে পারে ,কিংবা কাশি দিয়ে বের করে দিতে পারে।
ডক্টর স্পোক একাই যে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা না।সমসাময়িক অন্যান্য অনেক চিকিৎসক একই পরামর্শ দিচ্ছিলেন কিন্তু ওনার কাছ থেকে এটা অনেক জনপ্রিয়তা পায়। তার লেখা ঐ বইটা ৪২ টা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বাবা মায়েরা খুব মনোযোগ দিয়ে সেই বইয়ের পরামর্শ অনুসরণ করত। সেখানে অনেকগুলো ভালো পরামর্শের সাথে এই ভুল পরামর্শ টা ছিল খুবই দুঃখজনক। বিজ্ঞানীরা যখন জানতে পারলো শিশুদের উপুড় করে ঘুম পাড়ানো কতটা ক্ষতিকর,দেশে দেশে বিশাল কর্মসূচি হাতে নেয়া হল বাবা মায়েদের এটা বোঝাতে। যুক্তরাজ্যে back to sleep campaign শুরু করা হয়,যার ফলে এই ধরনের মৃত্যুর হার অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। ঠিক কিভাবে এই মৃত্যুগুলো হয়, তা নিয়ে এখনো আরো গবেষণা চলছে।তাহলে আমাদের করণীয় কি?
সুস্থ বাচ্চা হঠাৎ করে যাতে মৃত্যুবরণ না করে, সেজন্য কি করা যেতে পারে?
প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই কাজটা আপনারা করতে পারেন, তা হল শিশুকে চিত করে শুইয়ে ঘুম পাড়ানো। সেটা দিনের বেলার ঘুম হোক বা রাতের বেলার ঘুম হোক সব সময় ঘুমের জন্য শিশুকে বিছানায় চিত করে সোয়াবেন।উপুড় করে বা কাত করে সোয়াবেন না।এক কাত করে শোয়ালেও মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আবার এক কাত অবস্থা থেকে শিশুকে উপুড় হয়ে পড়তে পারে।তাই খেয়াল রাখবেন ঘুমের সময় শিশুর পিঠ যেন পুরোটা বিছানার গায়ের সাথে লেগে থাকে।এখন কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে সব সময় তো বাচ্চাকে চিত করে শোয়ায় মাঝে মাঝে এক কাত করলে হয়তো সমস্যা নাই। এটা করবেন না। গবেষণায় দেখা গেছে এমন করলে মৃত্যুর ঝুঁকি সাত থেকে আট গুণ বেড়ে যেতে পারে। শিশুকে একদম শুরু থেকেই চিত করে ঘুমানোর অভ্যাস করাবেন। শিশুর বয়স এক বছর হওয়া পর্যন্ত এমন চালিয়ে যাবেন।কারণ এক বছর বয়স পর্যন্ত যেকোনো সময় এমন মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক থেকে চার মাস বয়সী শিশুরা এর শিকার হয়। তাই বলে সারারাত জেগে শিশুকে পাহারা দিতে হবে না যে সে উপুড় হয়ে গেল কিনা। কিছু বড় হতে থাকলে এক সময় নিজে নিজে পাশ ফেরা শিখবে। ঘুমের মধ্যে সে যদি নিজে নিজে পাস ফিরে এক কাত হয় বা উপুড় হয়ে সয় গবেষণা দেখা গেছে যে তাতে সমস্যা নাই। তখন তাকে আবার ঘুরিয়ে চিত করার দরকার নাই কিন্তু তার ঘুম যাতে শুরু হয় চিত হয়ে শুয়ে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
শিশুকে কি কখনোই তাহলে উপর করা যাবে না?
অবশ্যই যাবে এবং এটা করা জরুরি।
শিশু যখন জেগে থাকে তাকে দিনে কয়েক বার উপুড় করে রাখবেন।তার সাথে খেলাধুলা করবেন। এতে ঘাড় এবং কাঁধের মাংস পেশী শক্ত হবে ,ফলে শিশু বসা , হামাগুড়ি ,হাঁটতে শিখবে।এটা শিশুর মাথা গোল রাখতে ও সাহায্য করবে শিশুকে এমন উপুড় করে রাখাকে বলে tummy time.
অর্থাৎ, শিশু পেটের উপোর সময় কাটাচ্ছে। এইটা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ কাজটা করবেন যখন শিশু জেগে আছে এবং অবশ্যই শিশুর আশেপাশে কাউকে থাকতে হবে যে এই সময় শিশুর উপর নজর রাখবে। হাতেগোনা কয়েকটা রোগের কারণে চিকিৎসক শিশুকে উপুড় করে শোয়ানোর পরামর্শ দিতে পারেন ঘুমের সময়ে।
সেটা শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করবেন। বাচ্চার আশেপাশে কাউকে ধূমপান করতে দেবেন না। সন্তান গর্ভধারণের সময় ধূমপান করা বা ধূমপান করছে এমন কারো আশেপাশে থাকা এবং শিশুর জন্মের পরে তার আশেপাশে কেউ ধূমপান করলে শিশুর এমন মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।এমনকি শিশুর সাথে যদি একজন ধূমপাই ব্যক্তি এক বিছানায় ঘুমায় তাহলেও শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যায় অর্থাৎ শিশুর আশেপাশে যারা থাকেন তারা ধূমপান ছেড়ে দেয়াই সব দিক থেকে শ্রেয়।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে তা এমন মৃত্যু থেকে সুরক্ষা সাহায্য করে। তাছাড়াও বুকের দুধ খাওয়ালে আরও অনেক উপকারিতা আছে। ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ আমরা দেই। আর বাচ্চা যেখানে ঘুমায় সেখানে বালিশ কাথা, কাপড়ের খেলনা যেগুলো বাচ্চার মাথা ঢেকে ফেলতে পারে শ্বাস আটকে যেতে পারে সেগুলো সরিয়ে রাখবেন। ঘুমানোর সময়ে বাচ্চার মাথা আর মুখ যাতে ঢাকা না থাকে আর খেয়াল রাখবেন ঘুমের সময় বাচ্চার শরীর যাতে খুব গরম না হয়ে যায়। খুব সহজ কিছু নিয়ম জানা থাকলে আর মেনে চললে আপনার ছোট্ট শিশুকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে দূরে রাখতে পারবেন। শেষ করার আগে বলে যায় ,
কখন শিশুকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?
যদি শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় বা শিশু দেখতে নীল হয়ে যায়, যদি শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, যদি শিশু অজ্ঞান হয়ে পরে বা মনে হচ্ছে চারপাশে কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না যা সে স্বাভাবিক ভাবে বুঝতে পারে।
ঘুম থেকে কিছুতেই তোলা যাচ্ছে না বা শিশুর যদি খিঁচুনি শুরু হয়।
আর কিছু মনের না রাখতে পারলেও শুধু এই স্লোগানটা মনে রাখবেন।
back to sleep ,tummy to play.
অর্থাৎ পিঠে ঘুম ,পেটে খেলা।
সুস্থ থাকবেন, শুভকামনা রইল।
Leave a Reply