উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার এই রোগটার প্রতিকার নিয়ে আজকে বিস্তারিত আলোচনা করব,
শুরু করছি কিভাবে উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয় সেটা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলতে,
আমাদের শরীরের রক্ত নালীগুলো রাবারের মত সেটা প্রসারিত ও সংকুচিত হতে পারে কিন্তু এই রক্তনালী যদি শক্ত হয়ে যায় তখন প্রয়োজন মত প্রসারিত হতে পারেনা, রক্ত চলাচলে বাধা বেড়ে যায় দেখা দেয় হায় ব্লাড প্রেসার। এছাড়াও প্রেসার বাড়ার আরো কিছু সূক্ষ্ম কারণ রয়েছে।
এখন খুব সহজ করে বুঝিয়ে বলছি প্রেসার বেড়ে গেলে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ?
এক, উচ্চ রক্তচাপের ফলে রক্ত নালি গুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে, রক্তনালী গুলোর দেয়াল পাতলা হয়ে বেলুনের মতো ফুলে ওঠে সেটা হঠাৎ ছিড়ে যেতে পারে তখন ব্রেনে মারাত্মক রক্তক্ষরণ দেখা দেয়, একই সমস্যা পেটের রক্তনালিতেও হতে পারে
দ্বিতীয় যে সমস্যাটা হতে পারে সেটা হল রক্তনালীতে চর্বি জমা সুস্থ স্বাভাবিক রক্তনালী তার গায়ে চর্বি জমতে দেয় না তবে উচ্চ রক্তচাপ রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে তখন রক্ত নালিগুলোর গায়ে চর্বি কোলেস্ট্রল ও ক্যালসিয়াম ডমাট বাঁধতে পারে আস্তে আস্তে এই চর্বি জমাট বড় হয় রক্তনালী সরু হয়।কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় চর্বির গায়ে এসে রক্ত জমাট বাঁধে এক পর্যায়ে রক্তনালীর মুখ পুরোটাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে তখন রক্ত আর সামনে আগাতে পারে না, এটা খুবই মারাত্মক ঘটনা
আপনারা নিশ্চয়ই ব্রেইন স্টক আর হার্ট অ্যাটাকের কথা শুনেছেন এইটা সেই ঘটনা ,
ব্রেন এর রক্তনালী বন্ধ হলে হয় স্ট্রোক তখন ব্রেইনের এক অংশ আর রক্ত পায় না কোষগুলো মরে যায়
একইভাবে হার্টের রক্তনালী বন্ধ হলে হয় হার্ট অ্যাটাক। এছাড়াও হাই ব্লাড প্রেসার দীর্ঘদিন থাকলে আরো অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে যেমন হার্ট দুর্বল হয়ে ,যাওয়া কিডনি ওকেজো হয়ে যাওয়া দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা দেখা দেয়া ইত্যাদি।
হাই ব্লাড প্রেসার এর সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে এর নীরবতা। হাই ব্লাড প্রেসার যখন শরীরে দেখা হয় তখন কোন ব্যথা বা অসুবিধা সৃষ্টি করে না, অধিকাংশ মানুষই আমরা এটাকে অগ্রাহ্য করি তখন হাই ব্লাড প্রেসার শরীরে আস্তে আস্তে ক্ষতি করতে থাকে।
হাই ব্লাড প্রেসারে কি খাওয়া যাবেনা?
প্রথমে বলি লবণ, দিনে কতটুকু লবণ খাচ্ছেন সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে দিনের চা চামচের পরিমাণে পনে এক চা চামচ থেকে কম লবণ খাবেন।
কি কি উপায়ে লবণ খাওয়া কমানো যায়?
নয়টা উপায় বলবো।
এক ,
ভাত খাওয়ার সময় আলাদা করে কাচা লবণ খাবেন না।
দুই ,
অনেকের কাছে মনে হয় ভাজা লবন খেলে কোন ক্ষতি নেই। লবণ ভাজা হোক বা কাঁচা হোক উভয়ই সোডিয়াম থাকে। আর সোডিয়াম ব্লাড প্রেসার বাড়ায়। তাই তরকারিতে লবণ কম দিতে হবে।
তিন,
সয়া সস, বিট লবণ, টেস্টি সল এগুলোতে বেশি পরিমাণে লবণ থাকে। রান্নায় তাই এগুলার বদলে অন্য কিছু ব্যবহার করবেন।
৪,
বাসায় রান্না করা খাবার,কিছু প্রাকৃতিক খাবারেও লবণ একটু বেশি থাকে ,সেগুলো এড়িয়ে চলবেন। খেলেও অল্প পরিমাণে খাওয়ার চেষ্টা করবেন। যেমন চিংড়ি মাছ,পুডিং কিছু কিছু ভর্তা বা আচার ইত্যাদি ।বাজার থেকে কেনা খাবার।
পাঁচ,
বাজার থেকে কেনা খাবার।রাস্তার পাশে টঙের দোকানের খাবার। হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টের খাবার যতটা পারেন এড়িয়ে চলুন। এগুলোতে কতটুকু লবণ দেয়া আছে? এটা আপনার জানা নেই। ব্লাড প্রেসারের রোগীদের অল্প লবন দিয়ে খাবার রান্না করা দরকার এবং লবণ পরিহার করা।
৬,
সয়া সস , টমেটো কেচাপ এড়িয়ে চলবেন। এগুলোতে অনেক লবণ থাকে।
৭ ,
নাস্তায় পুরি, সিঙ্গারা ,চপ ,নলডন্স,চিপস, স্যান্ডউচ,এসব পরিহার করলে নিজের অনেক উপকার করবেন। নাস্তার জন্য একটা ফল খেতে পারেন তবুও এগুলা খাবেন না। ফল আবার বিট লবণ দিয়ে মাখিয়ে খাবেন না।
৮ ,
যারা প্রক্রিয়াজাত খাবার কিনেন যেমন পাস্তা নুডুলস ইত্যাদি তারা প্যাকেটের গায়ে লবনের পরিমাণ দেখে কিনবেন। লবণ কম আছে এমন অপশন থাকলে সেটা দেখে কিনবেন।
নয়,
দাওয়াতে গেলে পোলাও বা ফ্রাইড রাইস না নিয়ে সাদা ভাত খাবেন। কারণ ভাত আমরা সাধারণত লবণ ছাড়াই রান্না করি। নান রুটি না নিয়ে সাধারণ শেখা রুটি খাবেন লবণ পরিহার করার জন্য।
ফ্যাট ,তেল, চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলবেন। দিনে তিন চা চামচের বেশি তেল খাওয়া যাবে না। সেটা মাছ-মাংস সবজি তরকারির সাথে হোক বা নাস্তার ভাজা পড়ার সাথেই হোক।
খাবারের ফ্যাট কমানোর ছয়টি উপায় বলছি
এক ,রান্নায় তেল ঢালার সময় চা চামচ ব্যবহার করবেন।তাহলে কতটুকু তেল দিচ্ছেন সেটা হিসাব রাখতে সুবিধা হবে।
২,মাংস খেতে হলে চর্বি ছাড়া মাংস বেছে নিবেন।
তিন, মুরগির চামড়া খেতে মন চাইলেও এড়িয়ে চলবেন। কারন মুরগির চামড়ায় অনেক ফ্যাট থাকে।
৪ ,ঘি আর মাখন থেকে দূরে থাকবেন। কারণে এগুলোতে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি।
৫, দুধের সর ফুল ক্রিম বা ফুল ফ্যাট দুধ এবং মিষ্টি দই খাবেন না। টক দই খাবেন।
৬,ডিম ভেজে না খেয়ে সিদ্ধ করে বা পজ করে খাওয়ার চেষ্টা করবেন। একটা ডিম ভাজতেই অনেকে এক থেকে দুই চামচ তেল ব্যবহার করেন।
এবার আসি খাবারের তালিকা থেকে কমাতে হবে এমন তিন নম্বর খাবারে। সেটা হলো চিনি,
সারা সপ্তাহের খাবারে যাদের দুই থেকে পাঁচ টেবিল চামচের কম চিনি থাকে। এ বিষয়ে দুইটি টিপস।
এক,
কোক ,সেভেন আপ,সফট ড্রিংকস প্রচুর পরিমানে চিনি থাকে এগুলো একদম না খাওয়াই ভালো।
দুই ,
টমেটো কেচাপ।এটাতে ভালো পরিমাণ চিনি থাকে। এটাতে লবন থাকে তাই এটা বাদ দিতে হবে।
লবণের মতোই তেল এবং চিনি বিভিন্ন রান্নার উপকরণ এবং খাবারের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে সতর্কতার সাথে রান্না করা এবং খাবার খাওয়া সম্পন্ন করতে হবে।
এবার আসি কি খাবেন?
কিছু কিছু খাদ্যে পটাশিয়াম থাকে যেটা রক্তচাপ কমায়। কোন খাবারে পটাশিয়াম থাকে আর কিভাবে বেশি পটাশিয়াম খাবেন,তিনটা উপায় বলছি।
এক ,দিনে চার থেকে পাঁচটা মাঝারি সাইজের ফল খাবেন বা সপ্তাহে অন্তত প্রতিদিন দুইটা করে ফল খাবেন।
দুই ,
দিনে দুই থেকে আড়াই কাপ কাটা বা রান্না করা সবজি খাবেন।অল্প অল্প করে পরিবর্তন করুন যদি সবজি তেমন খাওয়া না হয় তাহলে সিদ্ধান্ত নেন আপনি আগামী সপ্তাহে প্রতিদিন অন্তত একবেলা সবজি খাবেন। ফল আর শাকসবজিতে প্রাকৃতিকভাবে পটাশিয়াম মজুদ আছে। এগুলো আপনাকে রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। পটাশিয়াম বাড়ানোর জন্য ভুলেও নিজে নিজে পটাশিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া শুরু করবেন না।
খাদ্যে পটাশিয়াম বাড়ানোর তৃতীয় উপায় হল দুধ এবং দই। ফুল ক্রিম দুধ আর মিষ্টি দই খাওয়া যাবে না। কারণ সেগুলোতে ফ্যাট বেশি। খেতে হবে ফ্যাট ফ্রী দুধ কিংবা টক দই। দিনে দুই থেকে তিন কাপ ফ্যাট ফ্রি দুধ ও টক দই খেতে পারেন।
যাদের উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি অন্য রোগ আছে যেমন কিডনি রোগ আছে। অবশ্য একজন ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিবেন।
এবার আসি খাবার ছাড়া আর কি কি উপায়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখা যেতে পারে। উপায় বলবো।
এক ,ঔষধ,রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ঔষধের প্রয়োজন হতে পারে।আপনার অবস্থা অনুযায়ী ডাক্তার আপনাকে ঔষধ দিবেন দয়া করে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ বন্ধ করবেন না।
দুই, অতিরিক্ত ওজন কমানো। প্রতি এক কেজি অতিরিক্ত ওজন কমালে রক্তচাপ সাধারণত এক পয়েন্টের মতো কমে। যাদের ওজন বেশি। চেষ্টা করুন।
তিন ,নিয়মিত শরীর চর্চা করা। সপ্তাহে আড়াই ঘন্টা পরে নিয়মিত শরীর চর্চা করতে পারলে রক্তচাপ ৫ পয়েন্ট পর্যন্ত কমতে পারে। সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধা ঘন্টা করে দ্রুত হাটতে। একটা জিনিস উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা করবেন না সেটা হল ধূমপান। ধুমপান উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ধূমপান ত্যাগ করতে হবে।
নিরাপদে থাকবেন।
Leave a Reply