ফুটবল মাঠে মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি

গতকাল ডেনমার্ক বনাম ইংল্যান্ডের খেলা চলছিল। হঠাৎ মাঠের মধ্যে দৌড়ানো অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ডেনমার্কের ক্রিশ্চিয়ান অ্যারিস্টন, সংকেত পেয়ে খুব দ্রুত চিকিৎসক দল মাঠে প্রবেশ করেন কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝা যায় যে অবস্থা খুবই গুরুতর। পুরো স্টেডিয়ামে নেমে আসে নীরবতা। এরিস্টনের হার্ট বিট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এটাকে আমরা বলি cardiac arrest। এমন অবস্থায় সবচেয়ে মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়  সময়,তখন যুদ্ধ চলে ঘড়ির কাটার সাথে। দ্রুত সঠিক চিকিৎসার না পেলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যেতে পারে মানুষ। তখন খেলার মাঠেই চিকিৎসকরা শুরু করেন সিপিআর নামের এক জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা। 

এই সময় অ্যারিস্টনের সাথীরা চারপাশ ঘিরে দাঁড়ায় একটু আড়াল তৈরি করতে। রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করেন মাঠে এবং মাঠের বাইরে লক্ষ লক্ষ মানুষ। চিকিৎসা চলতে থাকে দশ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে। অবশেষে এরিস্টোনের হার্ট আবারও সচল হয়। তাকে স্ট্রেচেয়ার  করে হাসপাতালে নেয়া হয় পরবর্তী চিকিৎসার জন্য। এক ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে জানা যায় অ্যারিস্টটনের অবস্থা স্থিতিশীল হয়েছে। তার বাবা এবং তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। রেফারি প্লেয়ার ও চিকিৎসক এর দল সকলের কাটায় কাটায় সঠিক পদক্ষেপের কারণে একটা সেভ ফার্স্ট এইড এর মাধ্যমে প্রাণ বেচে গেল অ্যারিস্টটনের। এই পুরো তোর ঘটনাটা বিশ্লেষণ করার কারণ হচ্ছে প্লেয়ার ও রেফারির এর মত আপনার কি করণীয় যদি দুর্ঘটনার শিকার হন?

এরিস্টন স্বাভাবিক ভাবে দৌড়ে আসছিল তারপর

হঠাৎ করে তার শরীর ছেড়ে দেয় পায়ে জোর নাই, সামনে নইয়ে আসছে। এইটুকু  দেখলে বুঝা যায় তার সিরিয়াস কোন সমস্যা হয়েছে। কেন সিরিয়াস বলছি তা এখন বুঝাবো , একজন চিকিৎসক রোগী অজ্ঞান হওয়ার আগে কেমন লাগছিল সেটা জানার চেষ্টা করে। তার কি মাথা ঘুরাচ্ছিল?বমি বমি লাগছিল,মনে হচ্ছিল যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে?রোগী কি বসেছিল বা দাঁড়িয়েছিল?কি করছিল ?এগুলো জানলে অজ্ঞান হওয়ার কারণগুলো খুঁজে পেতে সহজ হয়। যদি রোগী বলে সে একদম ভালো ছিল কোন ধরনের কোন খারাপ লাগা ছিল না। হঠাৎ করে আশেপাশে মানুষ দেখল দেশে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। তখন প্রথমেই চিন্তা করি গুরুতর কিছু হতে পারে। হার্টের সমস্যার কারণে এমন হয়ে থাকতে পারে,ব্যায়াম করতে করতে বা দৌড়ানোর মাঝে কেউ যদি জ্ঞান হারায় তখন আমরা হার্ট নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। এখানে আমরা এই দুটো জিনিসকে দেখতে পাই,এরিস্টেন  দৌড়াচ্ছিলেন তার মাঝে হুট করে কোন ওয়ার্নিং ছাড়াই মাটিতে পড়ে যান।

তবে এরিস্টটনের সৌভাগ্য যে এ ঘটনাটা ঘটে পুরো দুনিয়ার সামনে। একা বাসায় এ অবস্থা হলে ব্যাপার অন্যরকম হতে পারতো।

এরিস্টন মাঠে পড়ে যাওয়ার পরে রেফারি দ্রুত খেলা বন্ধ করে চিকিৎসক দল মাঠে আনার আহ্বান করেন। এটা ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আপনারা প্রথমে এসে কি করলেন? এমন অবস্থায় রোগী দেখার জন্য আমরা একটা বিশেষ সিকোয়েন্স ফলো করি। সংক্ষেপে এটাকে বলা হয় এ ABCDe,যে জিনিসটির রোগীকে সবচেয়ে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে। এই সিকোয়েন্সটা ফলো করলে আমরা সবার আগে এই জিনিসটার জন্য চিকিৎসা করতে পারি। প্রথমে আমরা দেখি Airway অর্থাৎ শ্বাস নালীতে কোন সমস্যা আছে কিনা। রোগী যদি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে তখন ধরে নেই যে শ্বাসনালী ঠিক আছে। না, হলে মাথা ও চোয়াল একটা বিশেষ কায়দায় ধরে  শ্বাসনালী স্বাভাবিক রাখি।তারপর দেখি রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে কিনা, আমরা সাধারণত গলার এখানে পালস চেক করি।

ঠিক চোয়ালের  নিচে হাত দিলে আপনিও পাবেন। ডাক্তাররা তার মাথার কাছে এই কাজগুলো করছিলেন প্রথমে অ্যারিস্টন শ্বাস নিচ্ছিলেন পালস  ছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যায় হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কে এবং অন্যান্য অঙ্গের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় দ্রুত সঠিক চিকিৎসা না নিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যু ঘটে। আর দুধ কেন বন্ধ হয় সেটা বুঝিয়ে বলি, আমাদের হার্টে একটা ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম আছে যেটা মিনিটে হার্ট কয়বার কিভাবে বিট করবে সেটা ঠিক করে দেয়। এই সিস্টেম যখন ঠিকভাবে কাজ করে হার্ট ঠিক মতো রক্ত পাম্প  করে শরীরের সব জায়গায় পাঠাতে পারে। এই ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম যখন মারাত্মক গন্ডগোল হয়, হার্টবিট এলোমেলো ,দুর্বল, বা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হার্ট শরীরে আর রক্ত পাম্প করতে পারে না। এমন একটা কমন অবস্থা কে বলে ফেলটিক্যাল ফ্যাবরিলেশন। ,ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম এত এলোমেলো হয়ে যায় যে চারপাশ থেকে ফায়ার করতে থাকে তখন হার্ট পাম্প করার বদলে কাপতে থাকে,এই অবস্থায় রোগীকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত সিপিআর দিতে হয়। সিপিআর হল একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বুকের উপর ঘন ঘন চাপ প্রয়োগ করা,উদ্দেশ্য হল মস্তিষ্ক আর হার্টের রক্ত চলাচল করানো।

দ্রুত করতে পারলে রোগী বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ২ থেকে ৩ গুণ বেড়ে যায় ,এই সময় বল প্রয়োগ করে অনেক চাপ দিতে হয় মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার। এইটা এতটাই পরিশ্রমের কাজ যে একজন মানুষ সাধারণত এক থেকে দুই মিনিট ঠিকভাবে করতে পারে। তাই অন্য মানুষকেও পাস থেকে ডেকে নিতে হয় যাতে কোন বিরতি ছাড়া সিপিআর চালিয়ে যাওয়া যায়। 

এবার মাঠের আলোচনায় ফিরে আসি, যখন ডাক্তাররা দেখলেন যে এরিস্টোনের পালস বন্ধ হয়ে গেছে তারা সাথে সাথে সিপিআর শুরু করেন ।সিপিআর করার জন্য ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন নেই যে কেউ খুব অল্প সময়ে শিখে নিতে পারেন কিভাবে সিপিআর দেয়া যায়। হার্ড কাঁপলে বা পাম্প করতে না পারলে একটা ডিফেবিলেটর  যন্ত্রের মাধ্যমে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়,ইলেকট্রিক শক দেয়ার মধ্যে দিয়ে হার্টের এলোমেলো কাপাকাপি মুহূর্তের জন্য বন্ধ করা হয়। ডিফেবিলেটর ব্যবহার করতে যত মিনিট দেরি হয় ততই বাঁচার সম্ভাবনা কমতে থাকে অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে সিপিআর আর তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইলেকট্রিক শক দিতে পারলে রোগী বেঁচে যাওয়া সম্ভাবনা ৭৫% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এসবগুলো ধাপ অ্যারিস্টনের সাথে সময়মতো ঘটেছিল বলেই তিনি প্রাণে বেঁচে যান তারপরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার পরের ধাপ গুলো সম্পন্ন করার জন্য। বুঝতেই পারছেন ডিফেবিলিটর কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ডিফেবিলেটর  দুই ধরনের আছে অটোমেটিক আর ম্যানুয়াল, এই যন্ত্রটাই ধাপে ধাপে বলে দেয় কীসের পরে কি করতে হবে।

আর রোগীর প্রয়োজন না হলে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয় না।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Call Now Button